ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকত্তোর শ্রেণিতে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান পড়ানোর দায়িত্ব আমাকে মাঝে মাঝেই নিতে হয়। ভৌত বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে এই শাখার খানিকটা প্রভেদ আছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ভৌতবিজ্ঞানের আর সব শাখার মত পুরোপুরি ব্যাখ্যা ও বর্ণনার আয়ত্তে নেই। বিষয়টি বহুলাংশে বিমূর্ত ধরণের। কোন বিমূর্ত ধরণের বিষয় সম্পর্কে কাল্পনিক চিত্র তৈরি করা সম্ভব হয় না। আর সম্ভব হলেও খুব কাজের হয় না। সেই কারণেই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষক সবাই খানিকটা হতাশায় ভুগেন। আমার ব্যক্তিগত হতাশার কারণেই আমি কোয়ান্টাম রসায়ন এ একটি বই বাংলা ভাষায় লেখার কথা ভাবতে শুরু করি।
– হুমায়ূন আহমেদ
কোয়ান্টাম রসায়ন এবং হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি
হুমায়ূন আহমেদের জীবনের এই ঘটনাটি অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক এবং আমাদের অনেক কিছু শেখায়। যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রথম ক্লাসেই একজন অন্ধ সহপাঠীকে দেখে তিনি অবাক হন। তার পূর্বধারণা ছিল যে অন্ধ ছেলেমেয়েরা শুধুমাত্র অব্যবহারিক বিষয়গুলোই পড়েন, কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। একজন অন্ধ ছাত্র কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মত জটিল বিষয় বেছে নিয়েছিলেন এবং সেই বিষয়ের পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পান।
এটা দেখে হুমায়ূন আহমেদ অবাক হন এবং অনুপ্রাণিতও। প্রথম পরীক্ষায় শূন্য পেয়ে ফেল করার পর, তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এই বিষয়টি তার জন্য নয়। কিন্তু সেই অন্ধ সহপাঠীর অসাধারণ সাফল্য তাকে অনুপ্রাণিত করে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিবেন এবং তাকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। পরবর্তী সেমিস্টারে তিনি সেই বিষয়ের পরীক্ষায় ১০০% নম্বর পান।
এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে চ্যালেঞ্জগুলোকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করা উচিত এবং অন্যের সফলতা থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের এই অভিজ্ঞতা তার অধ্যবসায় এবং সংকল্পের এক অনন্য উদাহরণ, যা আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি।
কোয়ান্টাম রসায়নের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
কোয়ান্টাম রসায়ন হলো রসায়নের একটি শাখা যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূলনীতি এবং পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করে এবং পূর্বাভাস দেয়। এটি পারমাণবিক এবং আণবিক স্তরে ইলেকট্রনের আচরণ, রাসায়নিক বন্ধনের গঠন এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবিদ্যা সম্পর্কে গভীর ধারণা প্রদান করে। কোয়ান্টাম রসায়নের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কিছু দিক হলো:
- রাসায়নিক বন্ধনের ব্যাখ্যা: কোয়ান্টাম রসায়ন রাসায়নিক বন্ধনের প্রকৃতি বোঝার জন্য একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদান করে। ইলেকট্রন কীভাবে পারমাণবিক কক্ষপথে সংগঠিত হয় এবং কীভাবে তারা পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে তা বোঝা যায়, যা রাসায়নিক বন্ধন গঠনের প্রক্রিয়াকে পরিষ্কার করে।
- মৌলিক কণা ও বিক্রিয়া: এটি বিভিন্ন মৌলিক কণার (যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন) এবং তাদের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের গতিবিদ্যা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয়। কোয়ান্টাম রসায়ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিশীলতা ও বিক্রিয়ার বাধা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়।
- স্পেকট্রোস্কপি ও ইলেকট্রনিক স্ট্রাকচার: কোয়ান্টাম রসায়ন রাসায়নিক যৌগের ইলেকট্রনিক স্ট্রাকচার ও স্পেকট্রোস্কোপিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এটি বিভিন্ন পদার্থের স্পেকট্রোস্কোপিক সিগনেচার এবং ইলেকট্রনিক ট্রানজিশনের প্রকৃতি বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রক্রিয়ার অনুকরণ: প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেমন ফটোসিনথেসিস এবং কৃত্রিম প্রক্রিয়া যেমন নতুন ঔষধ বা ক্যাটালিস্ট ডিজাইনে কোয়ান্টাম রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
- গবেষণা ও উন্নয়ন: এটি নতুন পদার্থের বৈশিষ্ট্য, নতুন রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য উন্নত উপকরণের বিকাশে সহায়তা করে, যা ন্যানোটেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, এবং উপকরণ বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
এই কারণে, কোয়ান্টাম রসায়ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যা আমাদের রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং পদার্থের মৌলিক প্রকৃতি সম্পর্কে গভীরতর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে।
নিচের লিঙ্ক থেকে ডাউনলোড করুন
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী লেখক, যিনি বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ এবং নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। গীতিকার ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল, এবং তিনি সর্বোচ্চ সফলতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অসামান্য বই, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, এবং ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রগুলোও সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। তাঁর নাটকগুলো যেমন ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’, এবং ‘অয়োময়’ আজও দর্শকদের মনে অমলিন।
হুমায়ূন আহমেদ হিমু, মিসির আলি এবং শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক। তাঁর মাস্টারপিসগুলোর মধ্যে ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, এবং ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, এবং জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা অর্জন করেছেন। তাঁর কাজগুলো দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।