হোস্টেল সুপার মিসেস অনন্যা খানম রুম চেকিং এ এসেছেন।প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকিং এ আসে কারো কাছে মোবাইল আছে কিনা তা দেখার জন্য।
প্রতিবার ই কয়েক ডজন মোবাইল সার্চ করে নিয়ে যায় কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।আবার মেয়েরা লোকিয়ে ফোন কিনে ফেলে।এভাবেই চলতে থাকে টিচার আর স্টুডেন্টস এর চোর পুলিশ খেলা।
না বলে হুট করেই রুমে ঢুকে পড়ে মিসেস অনন্যা খানম।আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
যে কয়জন তাড়াতাড়ি করে ফোন লোকাতে পেরেছে তো বেচেঁছে আর বাকীরা হাতে নাতে ধরা পড়েছে।
কথা আর শেফা অতি চালাকীর সহিত নিজেদের মোবাইল একটা ব্যাগ এ ভরে জানালার গ্রীলে বেধে ব্যাগটা অপর প্রান্তে ঝুলিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে দিয়েছে।
এবার এরা দুজন সুবোধ বালিকার মত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
যাদের মোবাইল ধরে ফেলেছে তাদের কে ম্যাম ঝাড়ি দিচ্ছে তা শোনছে চুপচাপ।
সুমাইয়া নামের একজনের মোবাইল ধরেছে।মেয়েটি নতুন নতুন মোবাইল কিনেছে।সবে মাত্র কিছুদিন হলো কিন্তু অসাবধানতার ফলে মোবাইলটি ম্যামের হাতে চলে গেলো।
ম্যাম ধমক দিয়ে বলল,
“তুমি কি জানো না হোস্টেলে মোবাইল আনা নিয়মের বাহিরে? শোন মেয়ে তুমি নিয়ম ভেঙ্গেছো তাই তোমাকে তো শাস্তি পেতেই হবে কিন্তু তার আগে তুমি বলো এই রুমে কার কার মোবাইল আছে।”
সুমাইয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কোন কথা বলছেনা।
এই হোস্টেল জীবনটা এরকম যে এখানে যাইহোক, সবাই শাস্তি পাক কিন্তু আসল অপরাধীর কথা কেউ বলবে না।
সুমাইয়াকে বার বার ধমক দেয়ার পরও কারো নাম বলছেনা সে জন্য ম্যাম রেগে গেলেন।
বললেন,
“আমি জানি এই তোদের রুমে মোবাইল বেশী কিন্তু নাম বলছিস না! আচ্ছা ঠিক আছে সবাই কানে ধর।”
ম্যামের ঝাড়ি খেয়ে সবাই কানে ধরল।শুধু একমাত্র লিরাই রাগে গজগজ করছে।কারণ লিরার কাছে কোন মোবাইল না থাকা সত্বেও ওকে কানে ধরতে হচ্ছে সবার সাথে সাথে।
ম্যাম ওয়ার্নিং দিয়ে গেলেন এরপর যখন আসবে তখন কেউ এরকম করলে পুরা রুমের সবাইকে কানে ধরিয়ে কলেজ সহ সারা হোস্টেল ঘুরাবে।
ম্যাম চলে গেলো।কথা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
“বাপরে বড় বাচাঁ বেঁচে গেছি।একি ম্যাম নাকী আস্ত জল্লাদ!”
শেফা বলল,
“আর বলিস না, ভয়ে তো আমার হাত পা কাঁপছিল।কি একটা অবস্থা।”
লিরা চোখ মুখ কটমট করে বলল,
“এই তোদের জন্য, শুধু তোদের জন্য আমি নির্দোষ হয়েও শাস্তি পেলাম।”
কথা লিরার কাছে এসে বলল,
“আরে ইয়ার তুই না আমাদের বন্ধু।বন্ধুর জন্য একটু না হয় কানে ধরলি, তাতে কি এমন হয়েছে?”
লিরা আর কিছু বলল না, ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলতে লাগল।
সুমাইয়া কান্না করছে প্রানপ্রিয় মোবাইলটা ম্যামের হাতে পড়ায়, সবাই মিলে সুমাইয়াকে শান্তনা দিলো সেই সাথে প্রশংসাও করলো।বন্ধুদের জন্য ও কিছু বলেনি ম্যাম কে।সবাই সিদ্ধান্ত নিলো এজন্য সবাই সুমাইয়াকে নিজেদের মোবাইল দিয়ে কথা বলতে দেবে।
রাতে খাওয়ার বেল পড়েছে।সবাই প্লেট হাতে নিয়ে নীচে নেমে গেলো।লিরা এবং শেফা কথাকে বলল পানির আনার জন্য।কথাকে পানি আনতে গেলো আর ওরা দুজন ডাইনিং এর সামনে দাঁড়িয়ে কথার জন্য অপেক্ষা করছে।
কথা আবার সেই বড় গোসল খানায় পানি আনার জন্য এসেছে।খাওয়ার জন্য এই বড় গোসলখানার পানিই ব্যাবহার করা হয়।আর উপরের বাথরুমের জল ঘোলাটে থাকে তাই ঐ জল খাওয়া যায় না।
কথা গোসল খানায় এসে পানির ট্যাব টা ছেড়ে দিয়ে পানির বোতল ভরতে লাগলো।এমন সময় কথার মনে হলো কেউ ওকে খেয়াল করছে।পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।
আবার এমনটি লাগল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না।কথা পানির বোতল নিয়ে চলে এলো।
কথা চলে আসার পর একটি ছায়ামূর্তি হামাগুড়ি দিয়ে হাসতে হাসতে চেঞ্জিং রুমের ভেতরে চলে গেলো।
।
আজ খাবারের মেন্যুতে ডাল এবং সবজি সাথে ডিম।খাবারের এই মেন্যুটি প্রায় সবার কাছেই সব থেকে বাজে লাগে।তবুও খেতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে।
খাওয়া সেরে ওরা উপরে চলে এলো।রুমে এসে শেফা কথাকে বলল,
“মোবাইল গুলো বের কর।”
কথা বলল,
“রেখেছিলাম আমি এবার তুই বের কর।”
জানালা খোলতেই শেফার কেমন যেনো ভয় লাগছে।যদি কিছু হয়, এমনিতেই গত রাতে শশানে অদ্ভুত কিছু দেখেছে।কিন্তু না এনেও তো কোন উপায় নেই।
অগ্যতা শেফা জানালাটি খোলে ফেলল, জানালাটি খোলতেই এক ধমকা হাওয়া শেফার চুল গুলো উড়িয়ে দিলো।শেফা ভয় পেয়ে গেলো।
তবুও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো ব্যাগটি আনতে।এমন সময় কে যেনো শেফার হাত টি চেপে ধরলো।
শেফা হাতটি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোন ভাবেই সেই অদৃশ্য কিছুর বাধন থেকে নিজের হাত কে ছাড়াতে পারছে না।
কথা শেফাকে বলল,
“কি হলো শেফা?
এমন সময় শেফার হাত টি বাধন মুক্ত হয়ে গেলো।শেফা ব্যাগটি এনে বলল,
“কথা আমি আমি বোঝতে পারছি না আমার সাথে কেনো এমন হচ্ছে!
কথা শেফা কে জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো কি হয়েছে?
শেফা কাঁদোকাঁদো গলায় সব খুলে বলল।কথা সব শোনে বলল,
“শেফা আমি জানতাম এমন কিছু একটা হবে তাই আমি তোকে বলেছি মোবাইল আনার জন্য।”
শেফা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকালো কথার মুখ পানে।
কথা বলল,
“আমি যখম পানি আনতে গেছিলাম তখন মনে হয়েছিলো আমার পেছনে কেউ ছিলো আর আমাকে দেখছিলো।”
শেফা ভয়ে কান্না শুরু করে দিলো।কথা বলল,
“কান্না করিস না, আমি এই আত্মার রহস্য টা খোজে বের করব।”
শেফা তবুও কান্না করতেই থাকল।ভয় যেনো চেপে বসেছে ভালো করেই।
।
।
মিসেস অনন্যা খানম পরিক্ষার খাতা দেখা শেষ করে বলল,
“এই মেয়েরা না ভালো করে পড়বেই না।আবার পরিক্ষায় খারাপ করলে সব দোষ টিচারদের, টিচাররা পড়ায়নি ভালো করে এটা সেটা উফ।”
মিসেস খানম বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধোয়ে আয়নার দিকে তাকালো।তাকিয়ে দেখলো মিসেস খানমের মুখে ছোট ছোট অনেক গুলো চোখ গজিয়েছে।মিসেস খানমের সারা মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়ল।আবার তাকালো আয়নার দিকে একই দৃশ্য দেখতে পেলো।
চোখ গুলো থেকে পানি টপটপ করে পড়ছে।মিসেস খানম তোয়ালে দিয়ে পাগলের মতো মুখ ঘষছে।
এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছু নেই মুখে।মুখ একদম আগের মতই পরিষ্কার।
মিসেস খানম ঘেমে গেছে।কপালে ঘাম জমেছে।মুখ টা পরিষ্কার দেখে হাফ ছেড়ে বাচলো।
নিজেকে সামলে বিছানায় এসে বসলো।একটি বিভৎস চেহেরার বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে মিসেস খানমের পায়ে কামড়ে ধরলো।মিসেস খানম চিৎকার করতে লাগল।কিন্তু তার চিৎকার ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।মিসেস খানম বাচ্চাটির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোন ভাবেই ছাড়াতে পারছে না।বাচ্চাটি মিসেস খানমের দিকে তাকিয়ে হাসছে, কলিজা কাপানো হাসি।মিসেস খানম কান্না করে দিলো, পা ঝাটকা মেরে বাচ্চাটিকে সরিয়ে উঠে গেলো।দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই খোলতে পারলো না।শেষে কোন উপায় না পেয়ে আলমারিতে ঢুকে পড়লো।মিসেস খানম কাদঁছে, কি হচ্ছে ওর সাথে তা বোঝতে না পেরে আরো কাদঁছে।শাড়ির আচঁল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে উপরের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে ছিটকে পড়লো দূরে।
বাচ্চাটি টিকটিকির মত করে আলমারির ছাদে ঝুলে আছে।মিসেস খানম দৌড়ে বাথরুমে চলে এলো।
দরজা বন্ধ করে কাপঁতে লাগল মিসেস খানম।
হঠাৎ একটি মেয়ে পা টেনে টেনে হেটে আসতে লাগল মিসেস খানমের দিকে।মিসেস খানম চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
মেয়েটির মুখের একপাশ আগুনে পোড়ে গেছে, চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।সারা শরীরে রক্ত।
মিসেস খানমের পায়ে কামড় মেরে ধরল।মিসেস খানম চিৎকার দিয়ে মূর্ছা গেলো।
।
পরদিন মেয়েরা একে অপরের কাছে কানাকানি করতে লাগল মিসেস খানম কে নিয়ে।মিসেস খানমকে কে যেনো মেরেছে গত রাতে।উনি এখন হাসপাতালে।মিসেস খানমের এই অবস্থার কথা শোনে শেফা কথাকে বলল তাড়াতাড়ি করে।কথা বলল,
“উনাকে কে মারবে?
শেফা বলল,
“জানিনা কি হয়েছে উনার সাথে।”
কথা বলল,
“এই লিরা কোথায় ওকে তো দেখছি না।”
শেফা বলল,
“লিরাতো গোসলে গেছে।”
কথা বলল,
“এই সকাল বেলায়! মেয়েটা যে কি ছুটির দিনেও তার সকালে গোসল করতে হয়।”
ওদের দুজনের কথার মাঝে হঠাৎ বাহিরে হট্টগোলের আওয়াজ কানে এলো।সবাই একসাথে দৌড়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে।
শেফা বলল,
“কি হয়েছে বাহিরে?
“জানি না, এদের আবার কি হলো সবাই মিলে দৌড়াচ্ছে কেনো?
শেফা কথার হাত ধরে বলল,
“চল দেখে আসি।”
কথা এবং শেফা দৌড়ে বারান্দায় এলো।সবাই ২০৯ এর বাথরুমের সামনে ভীড় জমিয়েছে।
আবার একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।মেয়েটি আর কেউ নয় সেই আয়েশা।
যার পেটে দুই মাসের বাচ্চ।
আয়েশা হঠাৎ করে কেনো আত্মহত্যা করলো তার রহস্য কেউ বের করতে পারলো না।এটিকেও সাধারন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হল বরাবরের মতোই।
শেফা খুব চিন্তায় পড়ে গেলো,কথা বলল,
“এসব কি হচ্ছে? শুধু আমাদের এই বাথরুমেই এসব হচ্ছে! একের পর এক মেয়েরা আত্মহত্যা করছে।
প্রথমে এই শিখা এখন আবার এই আয়শা।”
শেফা বলল,
“আচ্ছা এরা কেনো মরছে? আদৌ কি মরছে নাকি কেউ মেরে ফেলেছে?
ওদের দুজনের কথাতে এই প্রথম কর্ণপাত করলো লিরা।
লিরা বলল,
“তোরা পারিস ও বটে আত্মহত্যা নিয়ে গভেষনা করে যাচ্ছিস।আচ্ছা বলতো মানুষ আত্মহত্যা কেনো করে?
যখন খুব বেশী কষ্ট পায় তখন।”
শেফা বলল,
“কিন্তু আয়শার কিসের কষ্ট? ও কেনো আত্মহত্যা করবে?
লিরা বলল,
“এইযে বোকার মত কথা বললি, আরে আয়শা কে ছোট থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।তাই হয়তো ও ডিপ্রেশনে চলে গেছিলো।তাই গলায় দড়ি ঝুলিয়ে পরপারে চলে গেলো।”
কথা বলল,
“ঠিক আছে লিরা আমি মানলাম এটা।কিন্তু যে মেয়ে ডিপ্রেশনে চলে যায় সে কি করে বাচ্চা নিতে পারে?
লিরা কথাটি শোনে আর কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না।
কথা বলল,
“তোর কাছে এর কোন জবাব নেই তা আমি ভালো করেই জানি।”
শেফা বলল,
“ছাড় তো লিরার কথা, আমাদের কে খোজে বের করতেই হবে কি হচ্ছে এসব।”
রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় শেফার গলা কেউ চেপে ধরলো।শেফা উঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
অনেক ক্ষন জবরদস্তি করার পর ও নিজেকে ছাড়াতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
“এই শেফা, শেফা কি হয়েছে তোর”
কথার এমন ডাকে ঘুম ভাঙ্গল শেফার।
জেগে উঠে নিজেকে জীবিত দেখে বিশ্বাস ই করতে পারছেনা যেনো শেফা সত্যি বেচে আছে।
কথা কে জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিলো।
.
.
চলবে….
লিখেছেনঃ রাহিমা নিশাত নিঝুম