মাঝ রাতে কান্নার শব্দে কথার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।একটা মেয়েলি কন্ঠের ডুকরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।কথা কান খাড়া করে শোনছে।কান্নার আওয়াজ টা রুমের ভেতর থেকেই আসছে।রুমের মাঝামাঝি কারো বেড থেকে।
কথা কে কাদছে তা দেখার জন্য এগুচ্ছে।ততোক্ষনে শেফাও জেগে গেছে।কথা এবং শেফা দুজন দুজনার মুখোমুখি হয়ে গেলো।শেফা কিছু বলতে যাবে তখন কথা শেফা কে থামিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বলল,
“আস্তে কথা বল! আমরা চুপি চুপি গিয়ে দেখবো কে কাদঁছে।”
শেফা মাথা নেড়ে সায় দিলো।ওরা দুজন খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে পা ফেলছে।কান্নার শব্দ কে অনুসরণ করে দুজনেই চলতে লাগল।যে বেড থেকে কান্নার শব্দ আসছিলো সেখানে গিয়ে থামলো দুজন।কথা ফোনের ফ্ল্যাশ অন করলো।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো কম্বল মুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে আর কম্বলের নীচ থেকে কান্নার শব্দ আসছে।
কথা এবার কম্বল টা সরিয়ে দিলো চোখের পলকে।যা দেখলো তাতে দুজনেই চরম ভাবে হতাশ হলো।
আরে এতো মিম, মিম-ই এতোক্ষন এভাবে কাদঁছিলো।
মিম তো এভাবে প্রায়-ই কান্না করে, কখনো বাবা মায়ের জন্য আবার কখনো বয়ফ্রেন্ডের জন্য।কিন্তু আজ এতো রাতে কি জন্য কান্না করছে তা জানার জন্য শেফা-ই প্রথমে জিজ্ঞেস করল
।মিম পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলো।ঘটনা টা এরকম ছিলো।
বিদ্যুৎ না থাকার কারণে মিম ওর এন্ড্রোয়েড ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বাথরুমে গিয়েছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হাত ফসকে মোবাইল টা কমোডে পড়ে যায়।
প্রিয় ফোনের অকাল মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে এভাবে শোক প্রকাশ করছে।কথা এবং শেফা চরম ধোকা খেলো।দুজনে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো।মিম কে শান্তনা দিয়ে দুজনে চলে এলো।
কথা শেফা কে বলল,
“এখন তো আর ঘুম আসবে না।চল আমরা মুড়ি ভর্তা করে খাই।”
শেফা বলল,
“তা ঠিক আছে কিন্তু মুড়ি কোথায় পাব?আমার তো নেই।”
কথা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোর কাছে আবার কি থাকে বলতো?
শেফা চুপ করে রইলো।কথা বলল,
“আচ্ছা চল আমরা বাহির থেকে ঘুরে আসি।”
শেফা আপত্তি জানিয়ে বলল,
“এতো রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে?
কথা অভয় দিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হবে না।চলতো।”
শেফা বলল,
“কিন্তু…
কথা শেফার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“আরে এতো ভয় পাস কেনো?
কিচ্ছু হবে না।আমি আছিতো।”
কথার এরকম জুরাজুরিতে শেফা আর না করলো।
কথা এবং শেফা দুজনে মিলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।বারান্দা দিয়ে হেটে সোজা তিন তলায় উঠার সিঁড়িতে বসে পড়লো।রাত ২টা বেজে ৪৫ মিনিট, বাহিরে কেউ নেই।শুধু ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।
কথা শেফা কে বলল,
“আচ্ছা শেফা তোর খুব ভয় করছে তাই না?
শেফা বলল,
“ভয় তো লাগছেই।কিন্তু কথা তুই বিশ্বাস কর এই হোস্টেলে কিছু তো আছেই।আমি দেখেছি অনেক বার।”
কথা শোনল শেফার কথা, শেফা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“তুই বিশ্বাস কর।আমার গলায় কাচঁ বিধেনি, একটা ভয়ংকর আত্মা আমাকে কামড় দিয়েছে।”
কথা বলল,
“কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট…
কথার মুখের কথাটা খপ করে কেড়ে নিয়ে বলল,
“ডাক্তারের রিপোর্ট কেনো ভূল আসলো তাতো জানিনা আমি।কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস কর।”
কথা শেফা কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আরে আমি জানি, আমি বিশ্বাস ও করেছি।কারণ আমার সাথেও ঘটেছে একই ঘটনা।”
শেফা অবাক হয়ে তাকালো কথার দিকে।কথা বলল,
“হ্যা আমার সাথে গোসল খানাতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে।”
শেফা বলল,
“কি ঘটেছিলো তোর সাথে?
কথা সব ঘটনা খোলে বলল।শেফা তা শোনে বলল,
“জানি না এই আত্মা টা কেনো পড়ে রয়েছে আমাদের পেছনে আর কেনোই বা আমাদের মারতে চায়!”
কথা বলল,
“আমি জানি না।এর কি শত্রুতা আমার সাথে।”
এতোটুকু বলে শেফার দিকে ফিরে বলল,
“আচ্ছা শেফা তুই বলতো, কবে থেকে এই সমস্যায় পড়েছিস?
শেফা এদিক ওদিক তাকিয়ে কথাকে সব কিছু খোলে বলল, বাথরুমের সেই মৃত্যু থেকে শুরু করে সব কিছু।
সব শোনে কথা বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না এই ঘটনায় তোকে ক্যান ফাসাচ্ছে আত্মাটি।”
শেফা কাদঁতে লাগল।কথা শেফা কে সান্তনা দিলো।
দুজনে রুমে চলে গেলো।সকালে উঠে কোন রকম নাকে মুখে খাবার খেয়ে কলেজে চলে গেলো।
কলেজ ক্যাম্পাসে বসে আছে তিনজন।লিরা, শেফা এবং কথা তিনজনে মিলে গল্প করছে।
লিরা বলল,
“এই আমার ক্লাস আছে এখন কিন্তু আজ না ক্লাস টা করতে ইচ্ছে করছে না।”
কথা বলল,
“তুই কবে নিয়মিত ক্লাস করিস চুন্নি একটা।”
লিরা ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমাকে একদম চুন্নি বলবি না।আমি কখনোই পড়ায় ফাকিঁ বাজি করি না।করিস তো তুই।”
কথ বেশ খুশির সহিত বলল,
“আমিতো ক্লাস করিই না, এটা আবার বলার কি আছে?”
লিরা বলল,
“যেখানে নিজেই ক্লাস করিস না সেখানে অন্য কে কেনো বলছিস?
কথা বলল,
“অটিস্টিক নাকি তুই! ঝগড়া করে যাচ্ছিস।”
শেফা অবস্থা বেগতিক দেখে বলল,
“আরে থামবি তোরা?
আসলে তোরা দুজনেই অটিস্টিক নাহলে ফ্রেন্ডরা এভাবে ঝগড়া করে?
কথা বলল,
“আমি কি এমন বলছি যে লিরা রেগে গেলো এভাবে!
শেফা বলল,
“হয়েছে হয়েছে এবার দুজনেই চুপ কর।”
কথা বলল,
“চল আমরা ক্যান্টিনে যাই।”
লিরা বলল,
“আমি যাবো না।”
কথা অন্য দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
“অটিস্টিক!
লিরা চোখ কটমট করে তাকালো।তা দেখে কথা অন্য দিকে ঘুরে গাছের পাতা গুনতে লাগল।শেফা দুজনের এই সব দেখে বলল,
“একটা থাপ্পড় মারব, ক্লাসে যা নাহলে আমাদের সাথে ক্যান্টিনে চল।”
লিরা আর কথা না বাড়িয়ে ক্লাসে চলে গেলো।
শেফা এবং কথা ক্যান্টিনে গেলো।বেঞ্চে বসে দুইটা চিপস নিয়ে খেতে লাগল।
শেফা বলল,
“শোন আমি আর এই হোস্টেলে থাকতে চাচ্ছি না।”
“কি বলিস? চলে যাবি?
শেফা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হুম চলে যাবো।”
কথা বলল,
“কিন্তু কেনো যাবি?
শেফা বলল,
“আমার প্রান সংকটে রয়েছে তাই আমি চলে যাবো।বাবা কে ফোন দিয়ে আসতে বলেছি।একটু পর বাবা আসবে।”কথা শেফা কে কিছু বলল না।কি বলবে, এখানে ভয়ে ভয়ে থাকার থেকে চলেই যাক।
।
কলেজ ছুটির পর খাওয়া দাওয়া সেরে শেফা রেডি হয়ে বসে আছে।কখন ওর বাবা আসবে আর ও চলে যাবে সেই জন্যে।
শেফার পাশে লিরা এসে বসল।শেফা হাসি মুখে বলল,
“আমি আজ চলে যাবো, কিন্তু জানিস তোদের খুব মিস করব।”
লিরা কিছু বলল না।শেফা লিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে কথা বলছিস না কেনো?
লিরা গোমড়া মুখে বসে আছে।শেফা মুচকী হেসে বলল,
“বুঝেছি আমি চলে যাবো তাই তোর খারাপ লাগছে।কিন্তু দোস্ত আমাদের তো কলেজে দেখা হবে।
আর আমিও তোকে খুব মিস করব রে।”
লিরার চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করলো।শরীর ঝাকি দিয়ে মুখ ঝামটা মেরে শেফার মুখের কাছে মুখ আনলো।শেফা লিরার এই আকস্মিক পরিবর্তনে ভয় পেয়ে গেলো।
লিরা মুখের দুই পাশে কালো কুচকুচে দাতঁ বেরিয়েছে।চোখের মনি কালো হয়ে গেছে।
লিরা কর্কশ গলায় বলল,
“চলে যাবি তুই?সত্যিই চলে যাবি?
বিচ্ছিরি একটা হাসি দিয়ে বলল,
“এতো সহজে ছেড়ে দেবো তোকে?কি ভেবেছিস তুই?
শেফা বলল,
“তুমি কে? কেনো আমার পেছনে পড়ে রয়েছো?
লিরা বলল,
“আমি শিখা, সেই মরে যাওয়া শিখা।”
শেফা বলল,
“তুমি আমার পেছনে কেনো পড়েছো?আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?আমিতো তোমাকে চিনিও না।
প্লীজ আমাকে ছেড়ে দাও।আমি তোমার হাত জোড় করে বলছি আমাকে মেরো না।”
কাদঁতে লাগল শেফা।লিরা হাসতে হাসতে লাগল তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“আমি কিভাবে মরেছি জানিস? আমি তীলে তীলে মরেছি কিন্তু কেউ আসেনি আমাকে বাঁচাতে।কিন্তু তুই এলি, অনেক পড়ে।ততোক্ষনে আমি মরে গিয়েছি।
এবার তো তোকে মরতেই হবে।”
শেফা বলল,
“তোমার মৃত্যুর জন্য আমিতো দায়ী নই তবে আমাকে কেনো মারবে?”
লিরা হাসতে হাসতে বলল,
“তুই হ্যা তুই ই দায়ী।তুই আরো আগে আসলে আমাকে মরতে হতো না।এবার তো আমি তোকে মেরেই দেবো।”
শেফা কাদঁতে কাদঁতে বলল,
“আমাকে যেতে দাও প্লীজ।”
লিরার ভেতর থাকা আত্মাটি বলল,
“তোর বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর, এখনি একটা গাড়ির নীচে চাপা পড়তে পড়তে বেচে গেল সে।”
শেফা করুন স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।বলল,
“তুমি আমার বাবার কোন ক্ষতি করো না প্লীজ।”
আত্মাটি স্বশব্দে হেসে বলল,
“এই নে ফোন, কথা বল তোর বাবার সাথে।”
শেফা লিরার হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে ওর বাবাকে ফোন দিলো।
শেফার বাবা ফোন ধরে বলল,
“হ্যা মা বল”
শেফা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা তুমি ঠিক আছোতো?
মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে ওর বাবা বলল,
“হ্যা আমিতো ঠিক আছি কিছু আমার বাইকটা উল্টে গেছে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে।”
শেফা এবার যেনো দিশেহারা হয়ে গেলো, আবার জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কিছু হয়নি তো বাবা?
ওর বাবা বলল,
“না মা আমার কিছু হয়নি।তুই চিন্তা করিস না আমি চলে আসব।”
শেফা বলল,
“না বাবা তোমাকে আসতে হবে না তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”
ওর বাবা বলল,
“কিন্তু মা তুইতো আসতে বললি আর এখন চলে যেতে বলছিস?
শেফা উত্তেজিত হয়ে বলল,
“বাবা আমার পরীক্ষা আছে কাল, হঠাৎ করেই এক্সামের ডেট ফিক্সড হয়েছে।আমি যেতে পারব না বাবা।তুমি ফিরে যাও।”
শেফার বাবা মেনে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে মা আমি ফিরে যাচ্ছি।আর তুই সাবধানে থাকিস আর ভালো মতো পরীক্ষা দিস।”
শেফা ফোন কেটে দিলো।লিরা শেফার কানের কাছে এসে বলল,
“সবে তো শুরু, আমি তোর জীবন টা শেষ করে দেবো।”
লিরার শরীরে আরো একটি ঝাকি দিলো।আর লিরা স্বাভাবিক হয়ে গেলো।এতোক্ষন কি হয়েছে এ ব্যাপারে লিরাকে কিচ্ছুটি বলল না শেফা।
কথা হাজার বার জিজ্ঞেস করেও শেফার না যাওয়ার কারণ টি জানতে পারলো না।শেফার মন খারাপ হয়ে আছে।
রাতে শোয়ে আছে।বিদ্যুৎ নেই গরমে অতিষ্ট হয়ে জানালাটি খোলে দিলো।
জানালার গ্রীল ভেদ করে বাহিরটা দেখলো কেমন চুপচাপ।শশানটা ভূতুরে লাগছে।শেফার আজ কেনো যেনো ভয় লাগছে না।শশান টাকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ ওর চোখে পড়ল কিছু মানুষ একটা মৃতদেহ নিয়ে এলো পোড়ানোর জন্য।
শেফা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।আজ ও দেখবে কি করে হিন্দুরা মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়।
মৃত মানুষ টির দিকে তাকালো শেফা, একজন নারী মনে হচ্ছে।
শেফা তাকিয়েই আছে হঠাৎ মৃত দেহটি চোখ মেলে তাকালো শেফার দিকে।তাকিয়ে খুব বিশ্রি ভাবে হাসলো যা দেখে শেফার কলিজা কেপে উঠলো।স্বশব্দে জানালাটি বন্ধ করে দিলো।
.
.
চলবে….
লিখেছেনঃ রাহিমা নিশাত নিঝুম