আজ কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি এসেছে ওরা।হোস্টেলে দিপাবলীর অনুষ্ঠান উৎযাপিত হতে চলেছে।তাই হোস্টেলে অনেক কাজ রয়েছে।
আলপনা আকাঁ, প্রদিপ গুলো সাজানো সহ আরো অনেক কাজ।
পুকুর পাড়ে মেয়েরা আলপনা আঁকছে।সাউন্ড বক্সে গান বাজছে।
লিরা আলপনা আঁকছে, লিরা আলপনা আকাঁয় অনেক দক্ষ।বাড়িতে নাকী নিয়মিত আকঁতো।
কথাও লিরাকে হেল্প করছে।আর শেফা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।
সারা দিন এইসব করতে করতেই কেটে গেলো।সন্ধ্যায় কথা গোসল করার জন্য বড় গোসল খানায় যাবে তখম শেফা বাধা দিয়ে বলল,
“এখন রাত হয়ে গেছে, তুই উপরেই গোসল কর।নীচে কেউ থাকবে না, ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।”
কথা বলল,
“কেনো? আমি নীচেই গোসল করব, কেউ না থাকলেও আমার সমস্যা হবে না।আমি ভয় পাই না।”
শেফা বলল,
“দেখ কথা পাগলামী করিস না।এমনিতেই গোসল খানা ভালো হয় না, আর তুই এই রাত্রিবেলা একা একা যাচ্ছিস।
শোন কথা এটা বাড়ি নয়, এটা হোস্টেল।এখানে যা ইচ্ছে হয়ে যেতে পারে।”
কথা উচ্চস্বরে হাসতে লাগল, শেফার রাগ উঠে গেলো ওর হাসি দেখে।কথা বলল,
“দোস্ত আমি তোর মত ভীতু না, আর না এই জ্বীন ভূতে বিশ্বাসী।”
শেফা বলল,
“জ্বীন বলে কিছু যে আছে তা একদম সত্য।কোরআনেও বলা আছে জ্বীনের ব্যাপারে।”
কথা বলল,
“আরে জ্বীন তো আছেই কিন্তু আমি বলেছি আত্মার কথা।ওসব হয় না বুঝলি?”
শেফা বলল,
“হোক বা না হোক আমি এসব কিছুই জানি না।আমি শুধু জানি তুই উপরেই গোসল করবি এবং আমি সঙ্গে থাকব।”
কথা বলল,
“কাম অন ইয়ার, ভয় পাসনে আমার কিচ্ছু হবে না।”
লিরা তখন শাড়ি পড়ায় ব্যাস্ত।ওদের কথার মাঝ খানে লিরা বলে উঠলো,
“এই শেফা তুই এই আত্মা টাত্মার কথা বাদ দে আর আমাকে শাড়িটা পড়তে হেল্প কর দোস্ত।”
শেফা বিরক্ত হয়ে লিরার দিকে তাকালো।কথা বলল,
“আরে যা না ইয়ার ওকে হেল্প কর।”
শেফা বিরক্ত হয়ে বলল,
“যাচ্ছি।”
লিরা কথাকে বলল,
“কিরে তুই খাম্বার মত দাঁড়িয়ে রইলি ক্যান?যা গোসল করে আয়।”
কথা বালতি আর কাপড় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।লিরা গলা উচিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু।”
কথা চলে গেলো।শেফা বলল,
“লিরা তুই এটা ঠিক করলি না।”
লিরা কানে গহনা পড়তে পড়তে বলল,
“কোনটা?
“এইযে কথা কে একাই পাঠিয়ে দিলি।”
লিরা বলল,
“হুম তো কি হয়েছে?
শেফা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“না কিছু না।”
লিরা শেফার গালে হাত দিয়ে বলল,
“তুই বড্ড বেশী চিন্তা করছিস।এসব কিচ্ছু হবে না ওর।”
শেফা কিছু বলল না।লিরা কপালে টিপ পড়তে পড়তে বলল,
“আমার ঠাম্মি কি বলতো জানিস?
বলতো বনের বাঘে নয়, মনের বাঘেই খায়।”
শেফা আর কথা বাড়ালো না।শেফা ভালো করেই জানে এই লিরা কখনো বিশ্বাস ই করবে না।তাই লিরার সাথে তর্ক না করে চুপচাপ থাকাই ভালো।
।
কথা গুন গুন করে গান গাইছে, পানির ট্যাপ টা ছেড়ে দিয়ে চুল গুলো আলগা করে দিলো।বালতিতে পানি ভর্তি হচ্ছে কথা সেটা দেখছে।আর বাহিরে হৈ হুল্লা আর বাজি ফোটার আওয়াজে থাকা যাচ্ছে না যেনো।কথা তাড়াতাড়ি গোসল টা সেরে কাপড় হাতে নিয়ে চেঞ্জিং রুমের দিকে এগুলো।গোসল খানার সাথে লাগানো রান্না ঘরের বাতি থেকে বাথরুমে যে টুকু আলো আসে তা চেঞ্জিং রুম পর্যন্ত পৌছে না।
চেঞ্জিং রুমের দরজা খোলা রাখলে যা একটু আবছা আলো আসে কিন্তু দরজা টা লাগিয়ে দিলে তাও আসে না।
আলো অন্ধকারের চেঞ্জিং রুম টাকে একটা ভূতুরে সিন্দুকের মত লাগছে।মনে হচ্ছে ভেতরে গিয়ে দরজা টা ভেজিয়ে দিলেই ইভিল ডেড বুক সিনেমার আত্মা টা তার গলা চেপে ধরবে।কথা এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল, মনে মনে বলল, “ধুর কি সব কি চিন্তা করছি।এসব হয় নাকি কখনো।”
কথা ধীরে ধীরে প্রথম চেঞ্জিং রুমের দরজা টা খোলল, ভেতরে প্রবেশ করে দরজা টা ভেজিয়ে দিলো।
কাপড় গুলো রাখার জন্য যেই সামনে পা বাড়ালো অমনি ধাক্কা খেলো কারো সাথে।
একটা মেয়ে কথার বিপরীত দিকে ঘুরে চুল মোছছে।
কথা ভয় পেয়ে গেলো।খানিক টা তুতলানোর মত করে বলল,
“তুমি ক কে তুমি?
কথার প্রশ্নে মেয়েটির মাঝে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা গেলো না।
কথা আমার বলল একই কথা।
মেয়েটি এবার কথার দিকে ঘুরে দাড়ালো তরিৎ বেগে।
মেয়েটির চেহেরা দেখে ভয়ে যেনো মরেই যাবে এবার।
সেইম আরো একটি কথা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কথা বলল,
“কে তুমি? আর ত তুমি এখানে কি করছো?
মেয়েটি কর্কশ স্বরে হেসে বলল,
“আমি কে জানতে চাও?
কথাটি বলে একটু থেমে মেয়েটি বলল,
“আমি তোমার আত্মা।”
কথা ভয় পেয়ে গেলো আরো।কথার মত দেখতে ঐ আত্মার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।চোখ যেনো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসছে।আত্মাটি নিজের মাথা হাতের উপর নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
“আচ্ছা মিস কথা, মনে করো তুমি মরে আত্মা হয়ে গেলে, অথবা মনে করো তুমি তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছো।তাহলে কেমন হবে?
কথা চিৎকার দিয়ে উঠলো বলল,
“না! তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।”
কথার এই আকুতিতে আত্মাটি হাসতে লাগল।আত্মাটি বলল,
“বড্ড সাহস বেড়েছে তোর।আমি তোর সাহস কমিয়ে দিচ্ছি দাড়া।”
আত্মাটি কথার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।কথা ভয়ে থরথর করে কাপছে।ভয়ে চোখ যেনো কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
আত্মাটি হাসতে হাসতে কথার দিকে এগিয়ে আসছে।কথা দরজা খোলে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে দৌড় দিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলো।
আত্মাটি হাসতে হাসতে এগিয়ে এসেছে কথার কাছে।কথা ভয় আর ব্যাথায় উঠতে পারছে না।আত্মাটি এই সুযোগে ওকে যখনি মারতে যাবে এমন সময় গোসল খাওনায় কেউ আসলো আর আত্মাটি উধাও হয়ে গেলো।
দুজন মেয়ে এসেছে পানি নিতে।মেয়ে দুটো পানি নিয়ে যখন চলে যাবে তখন চেঞ্জিং রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে কথাকে দেখতে পায়।
তাড়াতাড়ি করে কথার কাছে গিয়ে ওকে ধরে তুলে।
তারপর রুম নাম্বার জিজ্ঞেস করে দুজনে ধরাধরে করে কথাকে দু’তলার ২০৯ নম্বর রুমে নিয়ে যায়।
কথাকে কাপড় চেঞ্জ করিয়ে বিছানায় শোইয়ে দেয়া হলো।
মেয়ে দুটো বলল,
“আমার নাম রুবি আর ও আমার ফ্রেন্ড জিনাত।আমরা অনার্স থার্ড ইয়ারে আছি।”
শেফা অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলল,
“আপু আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।আপনারা ঠিক সময় না গেলে কি যে হতো ওর তা কল্পনাও করতে পারছি না।”
রুমি এবং জিনাত বলল,
“না না ধন্যবাদের কিছু নেই।”
লিরা ইতি মধ্যে বড় আপুদের আপ্যায়ন করতে বিস্কিট চানাচুর রেডি করে আনলো।রুবি এবং জিনাত সামান্য ফরমালিটিস মেইনটেইনের জন্য এসব না করতে একটু ইতস্তত করলো।
লিরা তবুও জোর করে সামনে দিলো।রুবি বিস্কিট মুখে দিয়ে বলল,
“তুমি এই রাতের বেলা একা একা বাথরুমে কেনো গেছিলে?তুমি জানো এই হোস্টেলে কত কি হয়? আর এ গোসল খানা!
ঐ গোসল খানা তো ভূতের আখড়া।”
কথা বলল,
“আপু আমি এসবে বিশ্বাস করিনা।”
জিনাত ধমক দিয়ে বলল,
“সাহসিকতা দেখানোর জন্য ওভার স্মার্ট হতে যেও না।এই হোস্টেল সম্পর্কে কোন ধারনাই তোমার নেই।এই হোস্টেলের বয়স ৭৫ বছর।
এতো পুরোনো জায়গায় কিছু নেই তা তুমি কি করে বলতে পারো?”
কথা কিছু বলল না।লিরা বলল,
“আপু এরপর থেকে আর আমরা কেউ একলা যাবোনা বাথরুমে।”
রুবি বলল,
“এই বাথরুমে অনেক মেয়েই অনেক কিছু দেখেছে।এসবের প্রমান ও আছে।কিন্তু তোমাদের বলতে চাইছিনা।কারণ তোমরা ভয় পাবে তাই।”
জিনাত বলল,
“আমরা এবার উঠি।অনেক দেরী হয়ে গেছে।কিন্তু তোমরা….বি কেয়ারফুল।”
রুবি এবং জিনাত চলে গেলো।শেফা লিরাকে বলল,
“শুধু তোর জন্য এমন টা হলো।আমি তো বলেছিলাম কথা কে একা যাওয়ার দরকার নেই।ও শোনল আমার কথা?”
কথা বলল,
“আরে থামবি তোরা?”
শেফা উত্তেজিত হয়ে বলল,
“কি থামবো হ্যা? বল কি থামবো? যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?
কথা বলল,
“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে I am sorry….আর কখনো রাতের বেলা একা যাবো না।”
শেফা বলল,
“মনে থাকে যেনো।”
কথার পায়ে এবং কোমরে একটু ব্যাথা পেয়েছে তাই লিরা এবং শেফা কথাকে শোয়ে থাকতে বলে ওরা নীচে চলে গেলো।
চারটে পুকুর ঘাট প্রদিপ দিয়ে ভরিয়ে দেয়া হয়েছে।সারি সারি প্রদিপ এ অদ্ভুত মায়াবী একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।বাজি ফোটাচ্ছে আর ফানুস উড়াচ্ছে মেয়েরা।উচ্ছাসে মেতে উঠছে হোস্টেল প্রাঙ্গন।
লিরা প্রদিপ ধরিয়ে ভাসিয়ে দিলো পুকুরে।শেফা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওদের এই অনুষ্ঠান।
লিরা বাজি ফোটাচ্ছে আর আনন্দে খিল খিল করে হাসছে।
ফর্সা আর মোহনীয় সুন্দর মেয়েটার মুখে যেনো পূর্নিমার চাঁদ ঢলে পড়ছে।ডাকের শব্দ আর লিরার হাসিতেই দিপাবলী যেনো সার্থকতা পেয়েছে।
লিরা শেফার দিকে তাকালো।তারপর শেফাকে ডাক দিয়ে বলল,
“শেফা আয় অনার্স ভবনের সামনে যাই।ওখানে বড় আপুরা আরতি দিচ্ছে।”
শেফা বলল,
“চল যাই।”
ওরা দুজন অনার্স ভবনের সামনে গেলো।ওখানে গিয়ে গিয়ে দেখলো তিন জন আপু ধুপ হাতে নিয়ে ঢাকের তালে তালে নেচে যাচ্ছে।একজন আপু তো আরো এক ধাপ এগিয়ে।জলন্ত ধুপ টা দাত দিয়ে কামড়ে নাচতে লাগলো।”
লিরা বলল,
“দেখ এরা কি সুন্দর করে আরতি দেয় কিন্তু আমি পারি না।”
শেফা বলল,
“কষ্ট পাসনে একদিন ঠিক পারবি দেখিস।”
ওরা দুজন ওখানে কিছুক্ষন থাকলো।তারপর একজন লিরা কে ডেকে নিয়ে গেলো।আর শেফা বলল,
“আমি রুমে চলে যাচ্ছি লিরা।তুই চলে আসিস।”
শেফা অনার্স ভবনের পাশ দিয়ে পুকুর পাড়ের নির্জন রাস্তা টা দিয়ে হাটতে লাগলো।এই রাস্তায় নাকী বড় আপুরাও ভয় পায়।
কিন্তু আজ কিসের ভয়।আজতো পুকুরের চার পাশ প্রদিপের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে।
শেফা ওসব ভাবতে ভাবতে হাটছে।তখন হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনতে পেলো।থমকে দাড়ালো শেফা।কান খাড়া করে শোনতে লাগলো।শেফার মনে হলো হোস্টেলের বাউন্ডারির বাহিরে যে বাসা টা আছে তার থেকে আসছে।তাই কিছু না ভেবে আবার পথ চলতে লাগল।
এবার কান্না টা আবার শোনতে পেলো কিন্তু আগের থেকে আরো প্রকট স্বরে।শেফা ভয় পেয়ে গেলো।আবার হাটতে লাগলো।ঠিক তখনি কালো কুচকুচে একটা বাচ্চা শেফার সামনে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পুকুরের দিকে নামতে লাগলো।কালো কুচকুচে এবং খুব শোকনা লিকলিকে কংকালের মতো দেখতে।হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় শেফার দিকে আড় চোখে তাকালো।
কি অদ্ভুত ভাবে হাসলো বাচ্চাটি।কলিজা কেপে উঠার মত হাসি। শেফা এক দৌড়ে চলে গেলো একদম গোসল খানার সামনে।রান্না ঘরের বারান্দায় বাবুর্চি মামা বসে আছে।
শেফা কে দেখে কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে তোমার এমন কেনো করছো?
শেফা ভয়ে কাপতে কাপতে কি যেনো বলল বোঝা গেলো না।বাবুর্চি মামা বলল,
“চলো তোমাকে রুমে পৌছে দিয়ে আসি।রাত ১২ টা বাজে তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না।”
শেফাকে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো।দু’তলার সিঁড়ি তে পা দিয়ে মামা বলল,
“সবে তো শুরু, এরপর দেখ আরো কত কি হয়?
শেফা বাবুর্চি মামার এমন কথা শোনে চমকে উঠে মামার দিকে তাকালো।মামার চেহেরা কেমন পালটে গেলো।চোখ দিয়ে ছোট ছোট বিচ্ছু বের হচ্ছে আর মামা সেগুলো ধরে মুখে চালান করে বলল,
“ঠিক এইভাবে চিবিয়ে খাবো তোকে।”
শেফা আর দেরী না করে প্রান পনে দৌড় দিলো।এক দৌড়ে ২০৯ নম্বর রুমে।
.
.
চলবে…..
লিখেছেনঃ রাহিমা নিশাত নিঝুম