“কি বলছো মেয়েটি প্রেগন্যান্ট? এতো অল্প বয়সী মেয়ে প্রেগন্যান্ট!”
শেফা যখন এই প্রশ্নটি করলো তখন লিরা বলল,
“হ্যা অল্প বয়সেই ওর বিয়ে হয়েছে।এসএসসি পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে গেছে।তারপর যখন ১মাসের প্রেগন্যান্ট হলো তখন ওর বর আউট কান্ট্রি তে চলে যায়।তাই পড়ালেখার খাতিরে ও হোস্টেলে এসেছে।”
শেফা বলল,
“ও আচ্ছা।কিন্তু ওর অনেক কষ্ট হবে।”
লিরা বলল,
“তাতো হবেই।কিন্তু চেষ্টা করলে মেয়েরা সব পারে।ঘর সংসার বাচ্চা সামলিয়ে পড়াশোনা করার রেকর্ড অনেক রয়েছে।”
শেফা আর লিরা কথা বলছিলো হোস্টেলে আসা নতুন মেয়ে আয়শা কে নিয়ে।
ওদের আড্ডার মাঝে দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পেলো।সবাই ঠিক হয়ে বসে দরজা খোলে দিলো।
আবার আরেকটি মেয়েকে নিয়ে এসেছে দারোয়ান মামা।মেয়েটি বেশ লম্বা এবং ফর্সা।চেহেরাতে কেমন চঞ্চলতার ছাপ।মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যায় মেয়েটি একটু দুষ্টু গোছের।দারোয়ান মামা বলল,
“মেয়েরা শোন ও তোমাদের সাথেই থাকবে।ওর সাথে সবাই মিলেমিশে থাকবে।ঝগড়া করবে না।ও নতুন তাই ওকে সবাই সাহায্য করবে।”
সবাই মাথা নাড়ল, দারোয়ান মামা চলে গেলো।নতুন মেয়েটি শেফার পাশে যে সীট টা খালি ছিলো তার পাশে বেড গোছাতে লাগল।শেফা বলল,
“হাই আমি শেফা।”
মেয়েটি হেসে জবাব দিলো,
“আমি কথা।”
শেফা বলল,
“আচ্ছা তুমি যদি কিছু মনে না করো তোমাকে একটা কথা বলব মিস কথা?
কথা নামের নতুন মেয়েটি বলল,
“হ্যা হ্যা নিশ্চই।”
শেফা একটু ইতস্ততভাবে বলল,
“তুমি জানালার পাশে বেড এ থাকো।”
কথা বলল,
“কেনো ওটা তো তোমার বেড।”
শেফা বলল,
“আসলে হয়েছে কি আমার জানালার পাশে ঘুমাতে একদম ভালো লাগে না।তুমি প্লীজ আমার জায়গাটায় এসো।”
কথা কি যেনো একটা ভাবলো তারপর বলল,
“ঠিক আছে।”
শেফা খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাবে তখন কথা বলল,
“এক মিনিট।”
শেফা থমকে তাকালো।
কথা বলল,
“আমরা নিজেদের জায়গা একচেঞ্জ করব তার আগে একদিন আমি তোমার বেড এ শুয়ে দেখতে চাই আমার এখানে ঘুম আসে কিনা।”
শেফা হতাশ হয়ে গেলো।তবুও একটা নিভু নিভু আশা কে আগলে ধরার প্রচেষ্টায় বলল,
“শিউর, তুমি সাচ্ছন্দে থাকতে পারো।”
কথা হাসল।
রুমের সবার সাথে একটু একটু করে সখ্যতা গড়ে উঠেছে শেফার।সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।বাড়িতে মা বাবার সাথে ফোনে কথা বলে নিলো।
রাতে পড়াশোনা শেষ করে সবাই রুমে এলো।
কথা শেফা কে বলল,
“শেফা শোন।
শেফা বলল,
“হ্যা বলো।”
কথা একটু নীচু স্বরে বলল,
“আজ নাকী এই রুমে কার বার্থ ডে?
শেফা বলল,
“আমি তো কিছু জানি না।তুমি কি কিছু জানো?”
কথা বলল,
“হ্যা একটু জানি, ওই সামনের দিকে কারো একজনের।”
শেফা বলল,
“আমি জানি না।হবে হয়তো, তোমার তো দেখছি অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।”
কথা বলল,
“আমি সবার সাথেই মিশতে ভালোবাসি।আমি চুপচাপ থাকতে পারি না।”
শেফা হেসে বলল,
“তুমি সত্যি অনেক মিশুক।সবার সাথেই মিশতে পারো।আমি আবার পারি না।”
কথা বলল,
“সারাদিন বই এর উপর মুখ গুজে রাখলে মিশবে কি করে সবার সাথে?”
শেফা একটু লজ্জা পেলো।কেউ তার প্রশংসা করলে খুব লজ্জা পায়।
লিরা ওদের কথার মাঝে এসে বলল,
“কি ব্যাপার তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?
কথা বলল,
“কিছু না এমনি।”
লিরা ওদের হাতে একটু সন্দেশ দিয়ে বলল,
“এই নাও এটা তোমাদের জন্য।”
কথা বলল,
“ওয়াও সন্দেশ? কিন্তু কেনো?”
লিরা বলল,
“আম্মু পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে এসেছিলো।সেটাই তোমাদের দিলাম।”
শেফা একটু অবাক হয়ে বলল,
“তুমি হিন্দু?
লিরা হেসে বলল,
“হ্যা কোন সন্দেহ?
শেফা বলল,
“আরেহ না।তুমি তো আমাকে বলোনি তাই।”
লিরা হেসে বলল,
“এইযে এখন বলে দিলাম।”
এতোক্ষনে কথার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।কথা বলল,
“সেটা কোন ব্যাপার না।ব্যাপার হচ্ছে সন্দেশ আমার খুবই পছন্দের।”
লিরা এবং শেফা দুজনেই হেসে দিলো।
কথা ঘুমিয়ে আছে শেফার বিছানায় আর শেফা কথার বিছানায়।
শেফার ঘুম আসছে না গরমে।গরম ও পড়েছে প্রচুর।
আর ইলেক্ট্রিসিটি ও নেই তাই শেফার গরমে যা’চ্ছে তাই অবস্থা।ঘুমাতে পারছে না।শেফা পানি খাওয়ার জন্য উঠলো।
পানির বোতল খুলে পানি খেলো।শোয়ার সময় কথা যেই বিছানায় শোয়ে আছে তার পাশ থেকে কুড়মুড়ে আওয়াজ আসছিলো।
শেফা কথার বিছানার নীচে তাকালো।কাউকে দেখতে পেলো না।কথার বিছানার সামনের টেবিল টার নীচে তাকিয়ে দেখলো একজন সাদা কাপড় পরিহিতা মেয়ে বসে আছে।শেফা ডাক দিলো,
“কে তুমি? এখানে কেনো বসে আছো?
মেয়েটি জবাব দিলো না।শেফা মেয়েটির কাধে হাত রেখে বলল,
“হেই কি হয়েছে তোমার তুমি এখানে বসে রয়েছো কেনো?
কথাটি শেষ হওয়া মাত্রই মেয়েটি শেফার দিকে তাকিয়ে শেফার চুল ধরে শেফাকে ফ্লোরে ফেলে দিলো।তারপর শেফার বুকের উপর বসে বলল,
“কি ভেবেছিস তুই?বিছানা পরিবর্তন করলেই বেচে যাবি তুই?
কখনোই না।”
শেফার বুকের উপর চেপে বসাতে ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।আত্মাটিকে সরানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু পারছে না।
আত্মাটির মুখের রক্ত শেফার মুখের উপর পড়তে লাগল টপটপ করে।আত্মাটি ভয়ংকর কন্ঠে বলল,
“আমি কিভাবে মরেছি জানিস?আমি তীলে তীলে মরেছি।মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করেছি।কিন্তু কেউ আমাকে বাচাঁতে আসেনি।তুই এই তুই আরো আগে কেনো আসলি না?আমি মরে যাবার পরেই তোর যেতে হলো ওয়াশরুমে?
শেফা ছটফট করছে ছোটার জন্য কিন্তু পারছে না।
আত্মাটি বলল,
“এইবার দেখ তুই মৃত্যু কি জিনিস।”
কথাটি বলেই শেফার ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো।গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল।
এমন সময় কথা জেগে উঠলো।শেফার আর্তিনাদ শোনতে পেয়ে নিজের মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করলো।শেফা কে দেখে ভয়ানক ভাবে চমকে উঠলো।
শেফার গলা থেকে অধরে রক্ত পড়ছে।শেফা কাতরাচ্ছে, এটা দেখে কথা সবাইকে ডাক দিলো।
শেফা কে সিক রুমে পাঠানো হলো, আর সেখান থেকে হাসপাতালে।
ডাক্তারদের মতে শেফার ঘাড়ে ভাঙ্গা কাচের টুকরো বিধেছে।কিন্তু শেফার স্পষ্ট মনে আছে এইটা কাচের টুকরোর ক্ষত নয়।এটি কামড়ের চিহ্ন।যা একেঁ দিয়েছে ঐ ভয়ানক আত্মাটি।
কথার প্রায় সবার সাথেই পরিচয় হয়ে গেছে।খুব ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেছে।
শেফার অনুপস্থিতি তে লিরা এবং কথা এক সাথে থাকছে।
লিরা আইসিটির অংক গুলো বঝার চেষ্টা করছিলো।আর কথা কলম ঘুরাতে ঘুরাতে কিছু একটা চিন্তা করছিলো।হঠাৎ চিন্তার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এসে বলল,
“আচ্ছা লিরা শেফার গলায় কাচের টুকরো গেলো কি করে?
লিরা অংকে মনোযোগ রেখেই বলল,
“হয়তো কাচের টুকরো ফ্লোরে ছিলো।”
কথা আবার বলল,
“কিন্তু কাচ আসবে কি করে?ওর কাছে কাচের এমন কিছু কি ছিলো যা ওর গলায় বিধতে পারে?
লিরা এবার মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,
“থাকতেই পারে, হয়তো সেটা ভেঙ্গে পড়েছিলো আর ওর গলায় বিধে গেছে।”
“কিন্তু গলাতেই কেনো বিধলো?হাতে পায়ে না হয় অন্য কোথাও তো বিধতে পারতো!
লিরা বলল,
“হয়তো ও পা পিছলে পড়ে গেছিলো।”
কথা বলল,
“তুমি হয়তো বলছো তারমানে শিউর না।আমার কি মনে হয় জানো?
মনে হয় ওর সাথে প্যারানরমাল কিছু ঘটেছে।”
লিরা উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।লিরা এতোটাই জোরে হাসলো যার জন্য রুমের অন্য মেয়েরা বিরক্ত বোধ করলো।
কথা বলল,
“আস্তে মেয়েদের ডিস্টার্ব হচ্ছে।আর এই তুমি এত উচ্চস্বরে হাসছো কেনো?”
লিরা বলল,
“হাসছি একারণেই যে এই যুগের মেয়ে হয়েও তুমি ভূতে বিশ্বাসী ।”
লিরা আবার হাসতে লাগল।
কথা লজ্জা পেয়ে চুপ মেরে গেলো।সত্যিই তো আত্মা বলে কিছু হয় নাকি! এসব তো শুধু গল্প সিনেমাতেই সম্ভব।ঐযে কথায় বলে না গল্পের গরু গাছেও উঠে।
কথা লিরার ঝাড়ি খেয়ে মাথা থেকে সব ঝেরে ফেলেছে।
।
শেফা এসেছে ১৫দিন বাদে, শেফাকে কেমন মন মরা আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
শেফা কে লিরা এবং কথা শান্তনা দিলো।
শর্তানুযায়ী কথা জানালার বেড সিট গোছাতে চাইলে শেফা বলল,
“থাক তুমি এখানেই থাকো।আর আমি আমার জায়গাতেই।”
কথা বলল,
“তুমি তো চেয়েছিলে আমি যেনো বিছানার পাশে যাই।”
শেফা বলল,
“হ্যা চেয়েছিলাম এখন বলছি আমি আমার জায়গাতেই থাকব।”
কথা বলল,
“কিন্তু…..
শেফা উত্তেজিত হয়ে বলল,
“বলেছি না আমি আমার জায়গাতেই থাকব।”
কথা আর কিছু বলল না।লিরা সবটাই লক্ষ করল।কথার কাছে এসে বলল,
“তুমি কষ্ট পেওনা।ওতো অসুস্থ তাই এমন টা বলছে।সুস্থ হলে তোমায় ঠিক স্যরি বলে দেবে।”
কথা হাসার চেষ্টা করলো।
শেফা ঠিকই পড়ে বোঝতে পারলো।তাই কথাকে স্যরি বলে দিলো।আবার ওরা আগের মতো হয়ে গেলো।
সন্ধ্যায় লিরা কথা এবং শেফা কে বলল,
“এই তোমরা আমার সাথে পুকুর পাড়ে যাবে?আমরা পুকুর এর চারটা পাড়ই ঘুরে ঘুরে দেখব।”
শেফা বলল,
“না না আমি পারব না যেতে।”
কথা বলল,
“কেনো পারবে না?”
শেফা বলল,
“অনার্স ভবনের পাশে দিয়ে যেতে পারব না।ওখানে বড় আপুরা আছে।”
লিরা বলল,
“তাতে কি হয়েছে?থাক বড় আপুরা।”
শেফা বলল,
“আমার বড় আপুদের দেখলে ভিষণ লজ্জা লাগে।”
শেফার কথা শোনে দুজনেই হেসে দিলো।তারপর কথা বলল,
“আরে বোকারাম লজ্জার কিছু নেই।উনারা আমাদের অনেক বড়, আমাদের বড় আপু।বড় আপুদের লজ্জা কিসের?”
অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজী করালো শেফা কে।
তিনজনে পুকুর পাড় দিয়ে হাটছে।এই হোস্টেলের সব থেকে বড় আকর্ষন হলো ইন্টার এবং অনার্স ভবনের মাঝের বিশাল পুকুরটা।তিনজনে পুকুর পাড়ে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।সন্ধ্যা সাতটায় ওরা রুমে চলে আসলো।
রাত আট টা বাজে।হোস্টেলের মেট্রন আপু আসলো মেয়েদের হাজিরা নিতে।
মেট্রন জানিয়ে দিলো গত পরশুদিন কলেজের হোস্টেলে সনাতনী ধর্মাবলম্বী দের “দিপাবলী” অনুষ্ঠান উৎযাপিত হবে।সবাই যেনো উপস্থিত থাকে অনুষ্ঠানে।
রাত ১২ টার পর কথা বাথরুমে যাবে তাই ব্রাশ নিচ্ছিলো।দাঁত ব্রাশ করে ঘুমানোর অভ্যাস ওর।
শেফা বলল,
“আমিও কি যাবো তোর সাথে?
এরই মধ্যে ওদের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তাই একে অপরকে তুই বলে সম্বোধন করছে।
কথা বলল,
“না বন্ধু! তুই বিশ্রাম নে আমি একাই যেতে পারব।”
শেফা বলল,
“ভয় লাগবে না?
“কিসের ভয়?এখানে তো ভূত পেত্নী নেই তাই না?”
শেফা কথার উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই জানিস না কি ঘটেছিলো এখানে….
এমন সময় লিরা শেফা কে থামিয়ে দিয়ে কথাকে বলল,
“আরে ওর গলায় কাচ বিধার কথাটাই বলছিলো বোধ হয়।
কথা আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
কথা চলে যাবার পর লিরা বলল,
“কিরে তুই ওসব ওকে বলতে যাচ্ছিলি।”
শেফা বলল,
“কেন বলব না? ওর তো জানা উচিৎ যদি ওর কিছু হয়ে যায়।”
লিরা বলল,
“তোর মাথা হবে।শুধু শুধু ওর ভয়হীন মাথায় ভয় ঢোকাচ্ছিস তুই।”
শেফা চুপ করে রইলো।
মাঝরাতে শেফার ঘুম ভেঙ্গে গেলো নুপুরের শব্দে।শেফা জেগে উঠে কথা কে ডাকতে লাগল।কথা ঘুম ঘুম চোখে জেগে বলল,
“কি হয়েছে ডাকছিস কেনো?
শেফা বলল,
“ওই শোন বাহিরে নুপুরের আওয়াজ আসছে।”
কথা বলল,
“নুপুরের আওয়াজ! কোথায় নুপুরের আওয়াজ?
শেফা সতর্ক হয়ে বলল,
“ভালো করে শোন।”
কথা শোনে হেসে বলল,
“গাধী এটা নুপুরের আওয়াজ নয় এটা এক প্রকার পোকার ডাক।”
শেফা বলল,
“না না এটা নুপুরের ই শব্দ।”
কথা শেফার কথায় কান না দিয়ে ঝাড়ি মেরে বলল,
“ভুলভাল না ভেবে ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে।”
কথা ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু শেফা কিছুতেই কথার কথায় ভরসা করতে পারলো না।ওর মনের মধ্যে খচখচানি লেগেই রইলো।কে আছে বাহিরে?যে এতো রাতে নুপুর পড়ে ঘুরছে।
বাহিরে একজোরা ঘুঙ্গুর পরিহিতা পা একে বেকে হেটে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।মুখে তার কুৎসিত হাসি।
চলবে…
লিখেছেনঃ রাহিমা নিশাত নিঝুম