“জানালাটি খোল না, হোস্টেলের পেছনেই শশান ঘাট।”
শেফা জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে হোস্টেলের বাহিরের গাছ পালা গুলো দেখছিলো।ঠিক এমন সময় লিরা পেছনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল।
শেফা চমকে পেছনে ঘুরে লিরার দিকে তাকালো।লিরা জানালার বাহিরে তাকিয়ে বলল,
“ঐ যে দেখছো সামনের জায়গা টা ঐটা হচ্ছে শশান ঘাট।এটাকে পাল পাড়ার শশান ঘাট বলা হয়।”
শেফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পাল পাড়ার শশানঘাট বলতে?”
লিরা বলল,
“হোস্টেলের পেছনের জায়গা টুকুর নাম পাল পাড়া।মহেশ পাল নামে একজন জমিদারের নামে নাম করণ করা হয়েছিলো জায়গাটিকে।আর যে শশান ঘাটটি দেখছো তা মহেশ পাল নিজেই স্থাপন করে গিয়েছিলেন।”
শেফা বলল,
“আমি তো খেয়াল ই করিনি।আর জানো আমি এই কবরস্থান গুলো কে খুব ভয় পাই তার উপর এটা আবার শশান ঘাট।”
লিরা অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল,
“হ্যা সাবধানে থেকো।”
লিরা চলে গেলো মুখে অদ্ভুত হাসি নিয়ে।শেফা তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলো।
হোস্টেলের নতুন মেয়ে শেফা, আজই উঠেছে।শেফার সিট পড়েছে হল রুমে। ২০৯ নম্বর রুমের একদম পেছনে জানালার কাছে।যেই জানালাটা খুললেই হোস্টেলের পেছনের শশানঘাট দেখা যায়।
শেফা রাতে কখনোই জানালা খুলে না ভয়ে।শেফা সেই ছোট থেকেই কবরস্থান কে খুব ভয় পায়।
আর আজ না জেনেই সে জানালাটি খুলে আছে।যে জানালাটি খোললেই সরাসরি শশানঘাট চোখে পড়ে।
ভাবতেই শেফার সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠলো।প্রথম তো শেফা বেশ খুশি হয়েছিলো জানালার পাশে সিট পড়ার কারণে কিন্তু এখন তার এখানে থাকতেই খুব ভয় হচ্ছে।
কিন্তু না থেকে উপায় নেই।একে তো নতুন, কাউকে চেনে না শুধু লিরা ছাড়া।তাই ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে।
রাত ১২ টা বেজে গেছে, সবাই পড়ার টেবিল ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।ঘড়িতে কাটায় কাটায় ১২:০০ বাজার সাথে সাথেই রুমের বাতি বন্ধ করে দিতে হয়।নাহলে জরিমানা হিসেবে ১০০টাকা করে দিতে হয় সবাইকে।
এই হোস্টেলের নিয়ম গুলো অনেকটাই কড়া।আর স্টাফরা ১২:০০ বাজলে সব গুলো রুম চেক করে।
২০৯ নম্বর রুমে তার ব্যাতিক্রম হলো না।সবাই ঘুমিয়ে গেছে।সুনসান নিরবতা, শুধু এই গরমে ফ্যানের ক্যাড়ক্যাড়ে আওয়াজটাই সব নিরবতা কে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।
শেফার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো।বালিশের পাশেই রাখা হাত ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখলো রাত ২:২৭ মিনিট বাজে।কেউ জেগে নেই।
শেফার বাথরুমে যেতে হবে।কিন্তু এতো রাতে কাউকে বিরক্ত করতেও ইচ্ছে করছে না।শেফা একাই বের হলো রুম থেকে।সোজা বারান্দার শেষ প্রান্তে বাথরুম।শেফা টয়লেট থেকে এসে ওয়াশরুমে গেলো ওজু করতে।শেফার অভ্যাসটা এরকম।প্রতিবার টয়লেট থেকে আসার পর অজু করে নেয়।
ওজু করার জন্য ওয়াশ রুমে যেতেই খুব ভয়ংকর একটা জিনিস দেখলো।সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে গেলো।ভয়ে মুর্ছা যাওয়ার উপক্রম।
স্টাফরা দৌড়ে চলে আসলো ওর চিৎকার শুনে।
শেফার সাথে স্টাফরাও দেখলো একটি মেয়ে মরে পড়ে আছে ওয়াশ রুমের ভেতরে, মেয়েটির নাকের কাছে পিপড়ার দলের লম্বা লাইন।
মেয়েটি তাকিয়ে আছে।মরার পর চোখ বন্ধ করার ও সময় পায়নি।সব রুমের মেয়েরা ভীড় করেছে এখানে।সবার চোখে মুখে আতংক।স্টাফগুলো ধমকিয়ে মেয়েদের রুমের মধ্যে তুলে বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো যাতে মেয়েরা বাহিরে না আসতে পারে।তবুও অনেকে জানালা খোলে দেখছে সব কিছু।হোস্টেল সুপার মিস অনন্যা খানম আসলেন ঘটনাস্থলে।স্বয়ং প্রিন্সিপাল ও এসে হাজির হলেন।হোস্টেল সুপার মিস খানম শেফার দিকে তাকালেন।
শেফাকে লিরা জাপটে ধরে রয়েছে আর শেফা ভয়ে কাপছে।তার চোখে ভয়।
মিস খানম স্টাফকে বললেন শেফাকে সিক রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মহিলা স্টাফটি হুকুম পালন করলো।
তারপর লাশটিকে মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।এরপর কি হয়েছে এবং মেয়েটি কেনো মারা গেলো, কিভাবে মারা গেলো তা কোন স্টুডেন্ট জানতে পারলো না।
এরকম একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেলো ২০৯ নম্বর রুমের ওয়াশরুমে।শুধু স্টুডেন্টরা এটা জানতে পারলো যে মারা গেছে সেই
মৃত মেয়েটির নাম শিখা।
শিখা ২০৮ নম্বর রুমে থাকে।
মেয়েরা বেশ কিছুদিন একে অপরের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করল, একটু ভয় পেলো তারপর আবার সব শান্ত হয়ে গেলো।
আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, হোস্টেলের সব কাজ ঠিক ভাবেই চলছে।মেয়েরা ক্লাস করছে, পড়ছে, যে যার যার কাজ সবই একই নিয়মে করছে।শুধু এই ওয়াশরুম টি এড়িয়ে চলছে প্রায় সবাই।
সবকিছু স্বাভাবিক হলেও শেফা কিছুতেই সেই বিভৎস দৃশ্যটি ভুলতে পারছে না।
লিরা শেফার কাছে এসে বসল।
শেফা লিরা কে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো।লিরা শেফার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ওসব কিছু ভুলে যাও।”
শেফা খানিকটা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকালো লিরার দিকে।
লিরা বলল,
“এখানে প্রায় ই এমন ঘটনা ঘটে।এগুলো স্বাভাবিক।এই ঘটনা গুলো তে টিচারদের কিছু আসে যায় না।”
শেফা বলল,
“কি বলছো তুমি? কিছুই আসে যায় না?
লিরা বলল,
“এতো বড় একটি হোস্টেলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে তাও আত্মহত্যা।এরকম মৃত্যুতে কার ই বা কিছু যায় আসে? তুমি যদি এটা ভুলে না যাও তাহলে তোমার ই ক্ষতি।”
শেফা সজোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ করলো।
সেদিনের পর থেকে শেফা তার মাথা থেকে এই ঘটনাটি মুছে ফেলার চেষ্টা করলো।
কিন্তু যে ঘটনাটি একবার মাথায় গেঁথে যায় তা কি সহজে তুলা যায়!
শেফা শুয়ে আছে, রাত ১২টা বেজে ৩০ মিনিট।
শেফা নিজের ছোট বেলার কথাগূলো মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু কেমন যেনো এলমেলো ভাবে মনে পড়ছে আজ।কিছুই গুছিয়ে মনে করতে পারছে না।চেষ্টা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেলো।ঘুমোনোর জন্য পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে যাবে তখনি একটা অবয়ব চোখে পড়লো।শেফার বাম পাশের মেঝেতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ।শেফা মিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পাড়ছে না।মনে হচ্ছে শেফা ভ্রম দেখছে।
তাই শিউর হওয়ার জন্য বার কয়েক চোখ ঝাকিয়ে ভালো করে তাকালো।ঠিক একই রকম জিনিস দেখতে পেলো।লাশটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আবছা আলোতে লাশের চোখটি জ্বলছে।লাশটি যেনো আস্তে আস্তে উঠে আসছে শেফার দিকে।
শেফা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে শুধু।মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ করতে পারছে না শত চেষ্টা করেও।
লাশটি শেফার বুকের উপর উঠে হাওয়ায় ভেসে রইলো।একটি ঠান্ডা শিহরণ খেলে গেলো শেফার শরীরে।ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে।
লাশটি বিভৎস চেহারায় একটু হেসে নিলো।তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুই যদি আরেকটু আগে আসতি তাহলে আমাকে মরতে হতো না।মৃত্যুর যন্ত্রনা যে কি ভয়ংকর তা তুই হাড়ে হাড়ে টের পাবি এবার।”
লাশটির ভয়ানক ফিসফিসার আওয়াজ যেনো শেফার কানের পর্দা ভেদ করে দিচ্ছে।
মাথায় ভোতা যন্ত্রনা হচ্ছে।লাশটি শেফার টুটি চেপে ধরতে গলার দিকে হাত বাড়ালো।
শেফা ভয়ে হাত পা ছুড়ছে।
এবার বুঝি মরেই যাবে।
“এই শেফা কি হয়েছে তোমার।”
বার কয়েক শরীরে ঝাকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো লিরা।
শেফা ঘুম থেকে উঠে বসল।লিরা বলল,
“তুমি ঘুমের মাঝে এমন হাত পা ছুড়ছিলে কেনো?আর কি সব বিরবিড় করছিলে।কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?
শেফা লিরার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো এই ভেবে যে একটুর জন্য প্রানে বেচে গেলো।
শেফা ভয় পাওয়া গলায় লিরাকে সব খুলে বলল।
লিরা শেফাকে বলল,
“এসব তোমার মনের ভুল।তুমি ওসব এখনো ভুলতে পারোনি তাই এমন আজে বাজে স্বপ্ন দেখছো।”
শেফা যে সত্যি দেখেছে এটা লিরাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারল না।
শেফা হাল ছেড়ে দিলো।
চলবে…
লিখেছেনঃ রাহিমা নিশাত নিঝুম